সচ্ছলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিশ্রমিকে লিঙ্গভিত্তিক ব্যবধানের ধারণা ও বৈষম্য বেড়ে যায়, বলছে সমীক্ষা

gendar

ডিবিএস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়া, ক্রিসিল (CRISIL)-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘উইমেন অ্যান্ড ফাইন্যান্স’ শীর্ষক তাদের সার্বিক সমীক্ষার তিনটি রিপোর্টের দ্বিতীয়টি প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্ট ভারতের ১০টি শহর জুড়ে আটশোর বেশি মাস মাইনে পাওয়া এবং স্বনিযুক্ত মহিলাকে নিয়ে করা হয়েছে। এই সমীক্ষা ডিজাইন করা হয়েছে তাঁদের পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার পছন্দগুলির আন্তঃসম্পর্ক উদ্ঘাটন করতে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রথম অংশের কাজকে এগিয়ে নিয়ে এই দ্বিতীয় রিপোর্টে কর্মীবাহিনীতে মহিলাদের তুলনাহীন অবস্থা সম্পর্কে মূল্যবান উপলব্ধি জানানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অভ্যাস এবং তাঁরা যেসব বাধার সম্মুখীন হন সেইসব। এতে দেখানো হয়েছে কীভাবে বয়স, আয়, বৈবাহিক অবস্থান এবং স্থান মহিলাদের পছন্দকে প্রভাবিত করে।

কর্মীবাহিনীতে মাসিক মাইনে পাওয়া মহিলাদের গতিপ্রকৃতি এবং তাঁরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তা বোঝা
মাইনের পরিমাণ এবং কেরিয়ারের উন্নতি মাইনে পাওয়া ৬৯% মহিলার চাকরি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানতম বিষয় বলে দেখা গেছে। অন্যদিকে ৪২% স্বনিযুক্ত মহিলা স্বাধীনতা এবং কাজের সময়ের নমনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেন। এই উপলব্ধি নানারকম প্রয়োজন ও পছন্দকে জায়গা করে দিতে কর্মক্ষেত্রের নীতিগুলিকে বদলে নেওয়ার গুরুত্বকে চিহ্নিত করে। লক্ষণীয়, দূর থেকে কাজ করা মাইনে পাওয়া মহিলাদের অনেকের মধ্যেই অগ্রাধিকার পায় না। মাত্র ৩% মনে করেন এই সুযোগ অবশ্য প্রয়োজনীয়।

এই সমীক্ষার ফলাফল কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন লিঙ্গবৈষম্য আছে বলে যে ধারণা ইন্ডাস্ট্রিতে চালু, তাকেই প্রমাণ করে। এই রিপোর্টে উদ্ঘাটিত হয়েছে যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক পারিশ্রমিকের ব্যবধান মাইনে পাওয়া মহিলাদের মধ্যে ২৩% বলে দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে বলে মনে করছেন ১৬%। মোটামুটি সচ্ছল মহিলা, যাঁরা বছরে ₹১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আয় করেন, আর সচ্ছল মহিলা, যাঁরা বছরে ₹৪১ থেকে ৫৫ লাখ টাকা আয় করেন, তাঁদের লিঙ্গভিত্তিক পারিশ্রমিকের ব্যবধান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নানারকম। সচ্ছল মহিলারা বেশি ব্যবধান রয়েছে (৩০%) বলে মনে করেন, মোটামুটি সচ্ছল মহিলাদের মতে এই সংখ্যাটি ১৮%। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের প্রশ্নেও এই একই প্রবণতা দেখা গেছে। সচ্ছল মহিলাদের ৩০% বলেছেন তাঁদের বৈষম্যমূলক ব্যবহার পাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই সংখ্যা মোটামুটি সচ্ছল মহিলাদের দলের থেকে অনেকটাই বেশি। তাঁদের ১২% এই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

মেট্রো শহরের ৪২% মাইনে পাওয়া মহিলা মাইনে নিয়ে দরাদরি করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। এই অভিজ্ঞতা ভারতের পূর্বাঞ্চল আর পশ্চিমাঞ্চলে আলাদা রকমের। কলকাতায় ৯৬% মাইনে পাওয়া মহিলার মাইনে নিয়ে দরাদরি করতে কোনো অসুবিধা হয় না, অন্যদিকে আমেদাবাদের মাত্র ৩৩% মহিলা তেমন মনে করেন। দক্ষিণ ভারতের মধ্যেও আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে। চেন্নাইতে ৭৭% মহিলার মাইনে নিয়ে দরাদরি করতে কোনো অসুবিধা হয় না, হায়দরাবাদে সেই সংখ্যা ৪১%।

কিশোর পোদুরি, ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড কান্ট্রি হেড – এইচ আর, ডিবিএস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়া বললেন “মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধিকার নিশ্চিত করতে কর্মীবাহিনীতে মহিলাদের অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া জরুরি। এই সমীক্ষা থেকে পাওয়া উপলব্ধি সংগঠনগুলোকে মহিলাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও ভাল করে বুঝতে এবং তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের কৌশল তৈরি করার সুযোগ দেবে। এর ফলে মহিলাদের কেরিয়ার আরও তৃপ্তিদায়ক হয়ে উঠতে পারে, কর্মীবাহিনীতে তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়তে পারে এবং তাঁদের পক্ষে যতখানি অবদান রাখা সম্ভব সেই ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাবে।”

তিনি আরও যোগ করেন “ডিবিএস হল এক অন্য ধরনের ব্যাঙ্ক এবং ‘উইমেন অ্যান্ড ফাইন্যান্স’ সমীক্ষা হল তার নীতিরই সম্প্রসারণ। মহিলারা আমাদের বিশ্বব্যাপী কর্মীবাহিনীর অর্ধেক এবং ভারতে আমাদের কর্মীদের ~৩০%। এই সমীক্ষার কিছু ফলাফলকে ব্যবহার করে আমরা তাঁদের বিচিত্র প্রয়োজন মেটাতে পারি এবং তাঁদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত – দুরকমভাবেই সাহায্য করতে পারি।”

পছন্দের নীতি ও উদ্যোগ মাইনে পাওয়া পেশাদারদের মধ্যে বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় অবিবাহিতদের মেন্টরশিপ ও কেরিয়ারের উন্নতির সুযোগের প্রতি পক্ষপাত বেশি। ২৬% অবিবাহিত মহিলা তেমন প্রোগ্রাম পছন্দ করেন বলে জানিয়েছেন, বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে সংখ্যাটি ১৬%।

আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণে এই উপলব্ধিগুলির গভীরতা বেশি। যেমন কলকাতায় ৪৬% মাইনে পাওয়া মহিলা মেন্টরশিপ এবং কেরিয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামগুলিকে সবচেয়ে মূল্যবান মনে করেন, যা জাতীয় গড় ১৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। একইরকমভাবে দিল্লিতে ৩৩% মাইনে পাওয়া মহিলা সংগঠনের দেওয়া শিশু পরিচর্যার সুযোগকে গুরুত্ব দেন, যার জাতীয় গড় ১১%। চেন্নাইয়ের মহিলাদের মধ্যে ৩২% বর্ধিত মাতৃত্ব সুবিধাগুলিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন, না জাতীয় গড় ৯ শতাংশের থেকে বেশি। এই পরিসংখ্যান ডিবিএস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার কর্মচারীদের মধ্যে যে আচরণ দেখা যায় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এক সাম্প্রতিক আভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় মহিলা কর্মচারীরা সবচেয়ে তাঁদের কাছে মূল্যবান উদ্যোগগুলির মধ্যে যেগুলিকে সবচেয়ে উপরে রেখেছেন সেগুলি হল কেরিয়ারে উন্নতির সুযোগ (১৯%) এবং গর্ভবতী মহিলাদের সহায়তা (১৬%)।

এই ফলাফলগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে সংগঠনগুলির পরিবারবান্ধব নীতি প্রয়োগ করা দরকার, যা পরিচর্যাদানকারী দায়িত্বগুলি ভাগ করে নিয়ে মহিলাদের ব্যক্তিজীবন-কর্মজীবনের সামঞ্জস্যের উন্নতি করে। পুনেতে ৩৫% মাইনে পাওয়া মহিলা মনে করেন দীর্ঘকালীন ছুটি সংক্রান্ত নীতিগুলি মূল্যবান, যা জাতীয় গড় ৫ শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

জীবনযাত্রা সংক্রান্ত পছন্দ
কর্মস্থলের গতিপ্রকৃতি ছাড়াও এই রিপোর্ট মহিলাদের জীবনযাত্রা সংক্রান্ত পছন্দের নানা দিকে নজর দিয়েছে এবং তাঁদের খরচ করার অভ্যাস, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা সংক্রান্ত অভ্যাস, ডাইনিং এবং অবসরে ভ্রমণের ব্যাপারেও নানা অন্তর্দৃষ্টি জুগিয়েছে। এই সমীক্ষায় জানা গেছে যে ভারতের মেট্রো শহরগুলির মহিলা আয়কারীরা ব্যস্ততা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেন। ৬৬% গতবছর সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন। ডিবিএস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার মহিলাদের মধ্যেও একইরকম প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এক আভ্যন্তরীণ সমীক্ষা বলছে উত্তরদাতাদের ৫৭% একই পর্বে সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন।

মাত্র ৩২% মহিলা সপ্তাহে একবারের বেশি বাইরে খান বা অর্ডার দিয়ে খাবার আনান, অন্যদিকে মাত্র ২৪% মহিলা দিনে চার ঘন্টার বেশি অফিসের কাজ ছাড়া স্ক্রিন টাইম কাটান। এতে সংগঠনগুলি নিজেদের দিক থেকে যা যা দিতে পারে তা বাড়ানোর সুযোগ স্পষ্ট। এই মহিলাদের সার্বিক সুস্থতার জন্যে নেওয়া উদ্যোগগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

৩২% বিবাহিত মহিলা গতবছর ৩-৫ বার বেড়াতে গেছেন, যা অবিবাহিত মহিলাদের দ্বিগুণ। বিবাহিত মহিলারা অবিবাহিতদের চেয়ে কম বেড়াতে যান বলে যে ধারণা চালু আছে, এই তথ্য তাকে চ্যালেঞ্জ করে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মহিলাদের প্রায় অর্ধেক (৪৭%) যথেষ্ট খরুচে। তাঁরা আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি খরচ করেন। এই সার্ভের ফলাফল আরও প্রকাশ করে যে এই সেগমেন্টের ৩৯% মহিলা বেড়ানো এবং কেনাকাটা করার মত ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডে যথেষ্ট বেশি টাকা খরচ করেন, যা জাতীয় গড়ের (৩৩%) তুলনায় বেশি।

ডিবিএস ১৯৯৪ সাল থেকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং শাখার উপস্থিতির দিক থেকে এটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদেশি ব্যাঙ্ক। ৩৫০ জায়গায় এর প্রায় ৫৩০টি শাখা রয়েছে। এই ব্যাঙ্ক তার সমাধান সম্ভারের মাধ্যমে ব্যাঙ্কিংকে সহজ এবং নির্ঝঞ্ঝাট করেছে; ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসার এবং খুচরো গ্রাহকদের বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। ব্র্যান্ড প্রতিশ্রুতি “লিভ মোর, ব্যাঙ্ক লেস”-এর উপর জোর দিয়ে ডিবিএস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়া মহিলাদের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করার চেষ্টা করে। সেই কাজে তাকে চালিত করে এই উইমেন অ্যান্ড ফাইন্যান্স সমীক্ষা।

আরও পড়ুন: গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা নিয়ে RBI-এর নতুন নির্দেশিকা

বাংলাবিজে প্রতিবেদনগুলি লেখেন ১০ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিকরা। সমস্ত তথ্য যাচাই করে তবে বাংলাবিজে প্রতিবেদনগুলি লেখা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.