সার কথা, রয়ে-সয়ে মেপে-জুপে গোড়া থেকে অভিযান হলে রিটায়ারের পরের জীবনেও বিড়ম্বনা অনেকটা কমে। মুম্বই থেকে লিখছেন অরুণাভ গুপ্ত
হ্যালো, গুড ওল্ড ম্যান ওকে… ঘাড় নেড়ে এগনোর মুখে ফের আওয়াজ, আজ ফাঁকা আছি দো মিনিট কে লিয়ে আসুন।
দেঁতো হাসি খেলিয়ে ঢুকলাম সমীর বাচওয়াতের বাড়িতে। বললেন, বছর চারেক আগে স্কুল থেকে রিটায়ার্ড করেছি। ওখানে ক্লার্ক বলতে একমাত্র আমিই ছিলাম। স্কুল সংক্রান্ত সব কাজ মায় সরকারি দফতরে ছোটাছুটি একা সামলাতাম। বড়দিদি থেকে দিদিমণি, সবাই সমীরদা বলতেই অজ্ঞান। ভগবান সহায়, রিটায়ার করার পরেও নিস্তার নেই। নয়া আদমিকে কাজ বোঝাচ্ছি, তবে ওপর ওপর। নইলে তো ভাত মারা যাবে, প্লাস দিদিমণিদের পার্সোনাল ফাইলের কাজ তো আগের মতোই রয়েছে।
জানতে চাই- এর জন্য পারিশ্রমিক কিছু পান না কি?
…. ক্ষেপেছেন! ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। অবশ্য বদনাম করব না, দিদিমণিরা কখনোই ওসব সুবিধা নেন না। বরং পুষিয়ে দেন। অন্য স্কুলের টিচারদেরও পাঠান। আর নতুনটাকে শেখাচ্ছি বলে বড়দিদি স্কুল ফান্ড থেকে একটা টাকা প্রতিমাসে বরাদ্দ করেন। এ সব কুড়িয়ে কাচিয়ে মন্দ নয়, ভালোই হয়।
সুমন রাজঘড়িয়া, বোঝা মুশকিল বয়স আশি পার করেছেন। দিব্যি টানটান হাঁটাচলা, রিটায়ার্ড পার্সন, পেনশন না থাকলেও টেনশন নেই। সুমন সুপার মার্কেটে এসেছেন, আমিও তাই।
কেনাকাটার ফাঁকে কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, সেদিন হঠাৎ এক কলিগের মুখোমুখি। আমি মশায় যোগাযোগ রাখি না, উপায় নেই দেখা হওয়ায় কথা বলতে হল। ইডিয়টের ইডিয়ট প্রশ্ন, বেকার জীবন কেমন কাটছে? খুব কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম, আমি ডান্স করি, বউ ড্রামা। কী করে বোঝাই ফালতুগুলোকে, রিটায়ার করার পর কাজের বহর একরাশ হয়। আমার রুটিন হচ্ছে, খুব ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াক তার পর নাতিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, আনা। বাজারহাট, ইলেকট্রিক বিল, ফোন, কেবল, ব্যাঙ্ক- যখন যেমন প্রয়োজন মুশকিল আসানের ভূমিকায় আমি। রিটায়ারের পর গোটা অঙ্ক বউকে তুলে দিয়ে বলেছি, তুমি হাইকম্যান্ড, সো ইওর প্রবেলম। না চলার কোনো কারণ নেই, কারণ একটাই ছেলে, সেটেলড বউমাও। নিজস্ব ফ্ল্যাট অফকোর্স পৈতৃক, নিজের ক্যালিতে করা অন্য ফ্ল্যাটটা ভাড়াতে খাটছে, একটা কানাকড়িও নিই না ছেলের কাছ থেকে। ডিসিপ্লিনড লাইফ লাঞ্চে অল গ্রিন ভেজিস দিয়ে কাটাপোনার ঝোল, ডিনারে একটা রুটি, একবাটি ছানা, ওয়ান্ডারফুল চলছি।
বিকাশ চৌরাসিয়া– সহজ-সরল অল্প কথার মানুষ। শোনেন বেশি, বলেন কম। আমার ওঁকে ভালো লাগল, উনি বলেন, ল্যাংগোয়েজ প্রবলেম থাকলেও আমাদের মধ্যে ওয়েভ লেংথ স্ট্রং। চাকরি জীবনের শেষে স্ত্রী বিয়োগ, মেয়ে সীমা প্রফেসর, বিবাহিত। বিকাশ মজা করে বলেন, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, গ্র্যাজুয়েশনের আগেই কপাল জোরে সরকারি চাকরি জুটেছিল। আমার মতে, ছেলে-মেয়েদের প্রথমেই সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসা উচিত। তা সে যতই কম হোক না কেন।
তা হলে এখন একেবারে একা?
শুনেই আমাকে হিড়হিড় করে ফ্ল্যাটে টেনে নিয়ে গেলেন বিকাশ। ঢুকে চোখ কপালে! বিশাল ফ্ল্যাট, চারটে ঘর। একটা নিজের বাকি তিনটেতে পাঁচটা করে ক্যাম্প খাট মানে পনেরো জন।
বিকাশ বলেন, মুম্বইতে থাকতে পাওয়া মানে স্বর্গ পাওয়া। এঁরা আমার পিজি। একাকীত্ব কাটল আবার টাকাও এল।
বললাম, মেয়ের অভিমত?
খোলা হাসলেন বিকাশ, হেসে গড়িয়ে বলেছে পারো-ও বটে!
সার কথা, রয়ে-সয়ে মেপে-জুপে গোড়া থেকে অভিযান হলে আর কেউ না থাকলেও বিকাশসাবের মতো ছানা-পোনায় কাটবে গো দিন কাটবে…