নিজস্ব প্রতিবেদন: রসগোল্লার মতো মোয়াও বাংলার নিজস্ব মিষ্টি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মোয়া জিআই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তবে, বাংলার একান্ত নিজস্ব এই মোয়া আজ যেন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। কী কারণে?
পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাব এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মোয়ার পাইকারি দোকানে নিম্নমানের মোয়া বিক্রির জেরে ক্ষতির মুখে জয়নগরের ব্যবসায়ীরা। নিয়ম মেনেই তৈরি হয় মোয়া। শীত এলেই বাঙালির পাতে চাই-ই চাই এই মিষ্টি। কিন্তু সে ভাবে কি আর তৈরি করা যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী মোয়া?
জয়নগরের মোয়া প্রস্তুতকারক জয়বীর চক্রবর্তী বলেন, “মোয়ার প্রাণ হল নলেন গুড়। সেই নলেন গুড়ই যখন আর খাঁটি পাওয়া যায় না তখন দোকানদারেরা খাঁটি মোয়া কী ভাবে বেচবে বলুন?”
মূলত মোয়া প্রস্তুত করতে লাগে দু’টি উপকরণ। কনকচূড় ধানের খই এবং খাঁটি নলেন গুড়। এ ছাড়াও কাঁচামালের মধ্যে প্রয়োজন গাওয়া ঘি, চিনি ইত্যাদি। জয়বীরবাবু বলেন, “আমাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে এই কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। আর সেখানেই দেখা দিয়েছে সমস্যা। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁচামালের মান নিম্নগামী হয়েছে। এখন আর খাঁটি নলেন গুড় সে ভাবে পাওয়া যায় না। কারণ শিউলির অভাব।”
তিনি জানান, “গাছ থেকে খাঁটি নলেন গুড় সংগ্রহ করতে ওঠেন শিউলিরা। এই শিউলির কাজে লোকের অভাব পড়ছে। মূলত যারা শিউলির কাজ করতেন, তাঁরা এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। পরের প্রজন্ম সে ভাবে আর এই কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে না। জয়বীরবাবু বলেন, “মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকেই শিউলির কাজ হতো। বেশিরভাগ মুসলিম তরুণরা এখন জরির কাজ কিংবা গ্রামেগঞ্জে হাতে ঠেলা গাড়িতে বাসন-সবজি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। তাই এই হাড়ভাঙা খাটুনি করে শিউলির কাজ করতে তারা চায় না।”
জানা গিয়েছে, ভোরবেলায় সংগ্রহ করা নলেন গুড় বিশেষ সুস্বাদু হয়। তাই শিউলিরা ভোর তিনটের সময় উঠে গাছে হাড়ি বেঁধে সংগ্রহের কাজ করে থাকেন। জয়বীরবাবুর কথায়, “নবীন প্রজন্ম এখন অলস, তাই ভোরবেলা উঠে শিউলির কাজ করতে তারা অপারক।”
গুড়ের পাশাপাশি গন্ধযুক্ত কনকচূড় ধানের চাষও কমে গিয়েছে। তাই জিআই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই জয়নগরের মোয়ার প্রাথমিক দুটটি কাঁচামাল পাওয়াই এখন দুষ্কর হয়ে উঠেছে মোয়া প্রস্তুতকারকদের কাছে। জয়বীরবাবু বলেন, “৩০ বছর আগে যখন দোকান শুরু করেছিলাম তখন ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে নলেন গুড় মিলত, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩০০-৪০০ টাকা কেজিতে। কনকচূড় ধানের বস্তা কিনতে হয় দেড় হাজার টাকা দামে।”
জয়নগর মজিলপুরে ৩০ বছরের পুরনো মোয়ার দোকান কমলা সুইটস চালান জয়বীর চক্রবর্তী ও তাঁর দাদা অরিন্দম চক্রবর্তী। এখানে ৩০০,৪০০ এবং ৫০০ টাকা প্রতি কিলো দরে মোয়া বিক্রি হয়। তারা জানান খুব সীমিত ক্রেতা রয়েছে, তাঁদের তাই ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে কিছুটা হলেও বিক্রি বাড়ে। সেইসময় প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় শিউলিদের থেকে ১৫ থেকে ২০ সের গুড় প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায় নিতে হয়।
এছাড়াও জয়বীরবাবু বলেন, “নগরায়ন গাছের সংখ্যা কমিয়েছে এখানে। তাই নলেন গুড় কিংবা কনকচূড় ধান চাষ অনেকটাই কমে গিয়েছে। আবার লোকের অভাবে অনেক গাছ থেকেই গুরু সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।” ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা পাইকারি দোকানগুলোর মোয়াকে জয়নগরের নামে চালানো নিয়ে বেশ আপত্তি রয়েছে তাঁর।
তিনি বলেন, “মিষ্টির দোকানে বিক্রি হওয়া মিহিদানা, সীতাভোগ কি বর্ধমানের নামে চালানো হয়? তা হলে যে কোনো দোকানে বিক্রি হওয়া মোয়া জয়নগরের নামে কেন দেওয়া হবে? খাঁটি নলেন গুড়, কনকচূড় ধানের খই ব্যবহার না করেও নিম্ন মানের কাঁচামাল দিয়ে তৈরি মোয়াকে জয়নগরের নামে চালানো হচ্ছে। এই ভেজাল মোয়া জয়নগরের ঐতিহ্যকে নষ্ট করছে।”
[ পড়তে পারেন: ব্যবসা শুরু করলেই কলেজ পড়ুয়াদের মিলবে বাড়তি নম্বর,হাজিরায় ছাড় ]
এ প্রসঙ্গে কলকাতার বাসিন্দা জয়নগর-মজিলপুর অতুলকৃষ্ণ বিনোদিনী ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠের শিক্ষক শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের ওখানে রামকৃষ্ণ আশীর্বাদ নামে দোকানগুলোতে মোয়া খেয়েছি, সেগুলোর তুলনায় কলকাতার অনেকটাই খারাপ। যে কোনো খই ও গুড় দিয়ে তৈরি এই মোয়াকে জয়নগরের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। আদতে তা খাঁটি জয়নগরের মোয়াই নয়।”