রূপসা ঘোষাল: দুর্গা প্রতিমা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুমোরটুলীর শিল্পীদের তৈরি মাটির মূর্তি। কিন্তু, ফেলে দেওয়া কাগজের মণ্ড দিয়ে দুর্গা মূর্তি তৈরি করে তাক লাগিয়েছে আবর্তনী। শুধু দুর্গা মুর্তিই নয়, আবর্তনী তৈরি করে রিসাইকেলড ল্যাম্প শেড, টি টেবিল, ম্যাগাজিন হোল্ডার এমনকী নোটবুক এবং পেন পর্যন্ত। যে পেন ব্যবহারের শেষে মাটিতে ফেলে দিলে গজাবে নতুন গাছ। ইকো পার্কের ৪ নম্বর গেটের কাছে রয়েছে আবর্তনীর বিশেষ স্টোর। রিসাইকেলড পদ্ধতিতে তৈরি জিনিসের সম্ভার নিয়ে সাজানো এই স্টোরটি তকমা পেয়েছে দেশের প্রথম রিসাইকেলড স্টোরের। ফেলে দেওয়া আবর্জনাকে নতুন রূপ দিয়ে নিত্যব্যবহার্য জিনিসে রূপান্তর ঘটাচ্ছেন গ্রাম বাংলার মহিলারা। এর ফলে আবর্তনী পিছিয়ে পড়া মহিলাদের স্বনির্ভর কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে।
২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পথ চলা শুরু হয়েছিল ‘আবর্তনী’ নামে এই স্টার্ট আপ সংস্থাটি। আর মাত্র বছর দেড়েকের মধ্যেই অভিনব পরিকল্পনা সাফল্য এনে দিয়েছে এই সংস্থাকে। পরিবেশ থেকে আবর্জনার পরিমাণ কমিয়ে এনে তা দিয়ে নতুন জিনিস তৈরি করার লক্ষ্য নিয়েই দুজন মিলে শুরু করেছিল আবর্তনী। উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের এই পরিকল্পনার মাধ্যমে যেন বেশ কিছু মানুষ কর্মসংস্থান পায়। হাতের কাজের মাধ্যমে রোজগার করতে সক্ষম হয়। সৌরভ মুখোপাধ্যায় এবং অর্পিতা লাহিড়ী মুখোপাধ্যায়ের মস্তিস্ক প্রসূত এই স্টার্টআপ। মার্কেটিং-এর দায়িত্ব সামলান রঞ্জন দত্ত। ভবিষ্যৎকে সুন্দর করে তোলার আকাঙ্খা নিয়ে নিজেদের মতো করে কিছু অন্যরকম করার উদ্যম নিয়েছিলেন তাঁরা।
নিজেদের পরিকল্পনায় দম আছে জেনেই কর্পোরেট জগতের মোটা মাইনের চাকরি ছাড়তে দুবার ভাবেনি ওঁরা। তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার চাকরি ছেড়ে আসা সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘প্লাস্টিক জাতীয় পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর বর্জ্য আটকানো এবং পরিবর্তে সেই সমস্ত কঠিন বর্জ্যগুলোর মাধ্যমে নতুন ব্যবহারযোগ্য জিনিস তৈরি করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হল প্রতিটা প্রতিষ্ঠান, অফিস কিংবা অবসনস্থল কে জিরো ওয়েস্টে পরিণত করা। এবং এই গোটা পরিকল্পনার মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। পিছিয়ে পড়া মহিলাদের স্বনির্ভর করতে তাঁদের দিয়েই কঠিন বর্জ্য থেকে নতুন জিনিস তৈরি করাচ্ছে আবর্তনী।’
ইকো পার্কের স্টোরটিতে আবর্তনী এক মাস ব্যাপী একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। যেখানে পিছিয়ে পড়া গ্রামের মহিলাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন ইকো ফ্রেন্ডলি সামগ্রী বিক্রি করা হয় যা সম্পূর্ণ ফেলে দেওয়া আবর্জনা থেকে তৈরি। হিডকো চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন এবং ব্রিটিশ হাই কমিশন ব্রুস বাকনেল এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। এক মাস ব্যাপী এই প্রদর্শনী থেকে সংস্থা আয় করেছে মোট ৮৭ হাজার টাকা। পাশাপাশি, সম্প্রতি, স্টেট রুরাল লাইভলিহুড মিশনের অন্তরগত মহিলাদের নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে রিসাইকেলড রাখি বানিয়েছে আবর্তনী। সেই ইকো ফ্রেন্ডলি রাখি এই মহিলাদের মাধ্যমেই বিক্রি করা হয় শহরের বিভিন্ন শপিং মলে। যেখান থেকে আবর্তনী আয় করে মোট ১৮ হাজার টাকা।
সৌরভ বলেন, ‘আমরা ইকো ফ্রেন্ডলি পেন পেন্সিল নোটবুক বানাচ্ছি বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসে বিক্রিও করা হচ্ছে। এই সামগ্রীগুলো ব্যবহার করার পর মাটিতে ফেলে দিলে তা থেকে গাছ তৈরি হয়। কারণ সামগ্রী গুলোর ভেতরে গাছের বীজ দেওয়া থাকে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা আবর্তনীর মাধ্যমে এই সামগ্রীগুলো তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। যা বিক্রি করে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।’
মাত্র দু লক্ষ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা এই স্টার্টআপ এখন 38 লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভার করাচ্ছে। মেয়েদের সাইকেল এবং সামগ্রীগুলো সারাদেশব্যাপী বিক্রির লক্ষ্যে আগামী দিনে অনলাইন প্লাটফর্মে আবর্তনীর সম্ভার নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে টেকনিক্যাল কোলাবোরেশনের পথে হাঁটছে আবর্তনী। আগামী প্রজন্মকে সুস্থ পরিবেশ উপহার দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে স্টার্টআপ আবর্তনী।